Header Ads

Header ADS

আসামে বিজেপির বিজয় এবং সম্ভাব্য শঙ্কা । সম্পাদকীয়

শেখ রোকন
ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের যে কোনো ঘটনা-অঘটনাই সীমান্তের এ পাশের বাংলাদেশে বিলক্ষণ প্রভাব ফেলে। সরকার পরিবর্তন বা নির্বাচনের মতো ব্যাপারে যে কারণে এ পাশের নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকদের তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও একটি বড় অংশের থাকে কড়া নজর। এপ্রিল ও মে মাসে কয়েক দফায় অনুষ্ঠিত দেশটির পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও স্বভাবতই তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম কেবল বাংলাদেশের নিকটতম ভূমিই নয়; এই দুই রাজ্যের সঙ্গে নৃতাত্তি্বক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। যে কারণে এই দুই রাজ্যে 'বাংলাদেশ কার্ড' বরাবরই জুতসই রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ইস্যুও বটে। এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই ইস্যু। পশ্চিমবঙ্গে মমতার প্রত্যাবর্তনের কারণে এই ইস্যুতে খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা নেই। কিন্তু আসামে কংগ্রেসের টানা তিন মেয়াদের রাজ্য সরকার এবারের বিধানসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজেপির দখলে চলে যাওয়ার ফলে সীমান্তের এ পাশ থেকে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, আসন্ন আসাম বিধানসভার ১২৬ আসনের মধ্যে বিজেপি এককভাবে বিজয়ী হয়েছে ৬০টি আসনে। তাদের নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটসঙ্গী অসম গণপরিষদ বা এজিপি ১৪টি এবং বোরোল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট বা বিপিএফ ১২টি আসনে জিতেছে। সাকল্যে ৮৬ আসন সরকার গঠন করার জন্য যথেষ্ট। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ভারতীয় কংগ্রেস গতবারের ৭৯ আসন থেকে নেমে এসেছে ২৬টিতে। ভোটের ফল গতবারের মতো হলে তাদের সম্ভাব্য জোটসঙ্গী মুসলিম নেতা বদরুদ্দীন আজমেলের নেতৃত্বাধীন এআইডিইউএফ হারিয়েছে পাঁচটি আসন। ১৮ থেকে ১৩টিতে নেমেছে।

বিজেপির এবারের নির্বাচনে সাফল্যের বেশ কয়েকটি কারণ সাব্যস্ত করেছেন ভারতীয় বিশ্লেষকরা। এর একটি হচ্ছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোতে কয়েক হাজার মৌলভীকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার। এমনকি মুসলিম প্রার্থী মনোনয়ন। তাদের মধ্যে দুইজন বিজয়ীও হয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রধান কৌশল ছিল 'বাংলাদেশ কার্ড'। বস্তুত ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি একই কার্ড খেলেছিল। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি আসামের বিভিন্ন জনসভায় বলেছিলেন যে, তারা সরকার গঠন করলে 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী' আসাম থেকে বহিষ্কৃত হবে। খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার কারণে বিধানসভা নির্বাচনে তিনি সরাসরি বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করেননি বটে, ঠারেঠুরে যা বলেছেন, তা লোকসভা নির্বাচনী প্রচারণারই পুনরাবৃত্তি। অবশ্য বিজেপির অন্য নেতারা বিষয়টি নিয়ে গলা ফাটাতে কসুর করেননি। বিধানসভা নির্বাচনের আগে তার দল থেকে প্রকাশিত ইশতেহারেও বলা হয়েছিল যে, বিজেপি রাজ্য সরকার গঠন করতে পারলে তিনটি কাজ করবে- 'অনুপ্রবেশ' বন্ধ, তাদের ভাষায় 'অবৈধ' অভিবাসীদের বের করে দেওয়া এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সিল করে দেওয়া। তাদের জোটসঙ্গী অসম গণপরিষদের রাজনীতির ভিত্তিও হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী ইস্যু। অগপ মূলত অহমিয়া জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন সময়ে আসামে 'বঙ্গাল খেদা' আন্দোলনে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এই ইস্যুকে পুঁজি করেই তারা ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে দুই মেয়াদের জন্য রাজ্য সরকার গঠন করেছিল। বোরোল্যান্ড পিপলস ফ্রন্টও উজান আসাম এলাকায় তাদের জাতিগত অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার জন্য 'বহিরাগতদের' দায়ী করে থাকে।

তথাকথিত অবৈধ অভিবাসী বা অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি ও মোদি মন্ত্রিসভার সদস্য সর্বানন্দ সানিয়াল। আরও ভেঙে বললে, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারই গড়ে উঠেছে এই একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে। তিনি ছিলেন অসম গণপরিষদের মূল শক্তি অসম ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতে মূল দলের 'দোদুল্যমান্যতা' নিয়ে মতবিরোধের জেরেই তিনি অগপ ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং লোকসভায় নির্বাচিত ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। নির্বাচনী ফল প্রকাশের দিনও তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম কাজ হবে আসাম-বাংলাদেশ সীমান্ত 'সিল' করে দেওয়া এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করা। নির্বাচনে বিপুল বিজয় এবং 'বহিরাগত' ইস্যুতে মারমুখী দুই জোটসঙ্গী নিয়ে তার এমন তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো মোটেও কঠিন হবে না, বলাবাহুল্য। এর ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ সমাজ ও রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে আমরা কী করব? আসামে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে বাংলাদেশের নিছক দর্শকের ভূমিকায় থাকা উচিত হবে না। এর আগে বহুবার ব্যক্ত করা এ অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে হবে যে, আসামের সঙ্গে আমাদের ভৌগোলিক, নৃতাত্তি্বক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঘনিষ্ঠতাকে সেখানকার রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে সম্মান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশ বিভাগের আগে আমরা একই দেশের অংশ ছিলাম। দেশ বিভাগের সময় অনেক পরিবার যেমন তৎকালীন পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে গেছে, তেমনই অনেকে ভারত ছেড়ে এখানে এসেছে। দুই দেশের সীমান্ত রেখা ভৌগোলিকভাবে অভিন্ন হওয়ার কারণে এখনও অনেক পরিবারের সদস্যরা সীমান্তের দুই পাশের নাগরিক। কেউ বাংলা ভাষায় কথা বললে বা ধর্মীয়ভাবে মুসলিম হলেই তাকে 'বাংলাদেশি' তকমা দেওয়ার অবকাশ নেই। আসাম রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের 'অনুপ্রবেশকারী খেদাও' পদক্ষেপের আগেই বাংলাদেশকে কূটনৈতিক চ্যানেলে এই বার্তা দিতে হবে। বলতে হবে, নির্বাচনী দাঁও মারার জন্য 'বাংলাদেশ কার্ড' খেলেছো ভালো কথা; আমাদের এখানেও নির্বাচনের সময় 'ভারত কার্ড' খেলা নতুন নয়। কিন্তু তার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত জনমিতি বদলানোর চেষ্টা কারও জন্য ভালো হবে না। বাংলাদেশের জন্য তো নয়ই, ভারতের জন্যও নয়। কয়েক দশকের সশস্ত্র সংগ্রাম, জাতিগত দাঙ্গার ফেরে উন্নয়নে পিছিয়ে থাকা আসামের জন্য নতুন করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরির উদ্যোগ হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ মাত্র।

সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

http://bangla.samakal.net/2016/05/21/213475
Powered by Blogger.